Wednesday, November 27, 2013

সমকামিতা ও আমাদের সমাজ

সমকামিতা হল সমলিঙ্গের মানুষের মধ্যে প্রেম, প্রণয় ও যৌন সম্পর্কের নাম। অর্থাৎ পুরুষের সাথে পুরুষের বা নারীর সাথে নারীর প্রেমের সম্পর্ককে বোঝানো হয়। সমকামি পুরুষ যুগল "গে" ও নারী যুগল "লেসবিয়ান" নামে পরিচিত। এই নামকরণের পেছনেও আছে ইতিহাস। সংক্ষেপে বললে, প্রথম দিকে যখন গে শব্দটি ব্যবহার করা হয় তখন এটি হাসিখুশি অর্থে বুঝানো হতো। পরবর্তীতে ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে লিসা বেন নামক একজন সম্পাদক এটি প্রথম ব্যবহার করেন। এরপর থেকে পুরুষদের সমকামিতার এই নামকরণ শক্তভাবে প্রতিষ্ঠা পায়।


সমকামি মেয়েদের ক্ষেত্রে "লেসবিয়ান" শব্দের প্রচলন বহু আগে থেকেই। এর ইতিহাসটাও চমৎকার। যিশু খ্রিষ্টের জন্মের ছয় শতক পূর্বে গ্রিসের লেসবো দ্বীপের স্যাপো নামের একজন শিক্ষিকা মেয়েদের মধ্যকার প্রেম নিয়ে কাব্য রচনা করেন। শুধু কবিতা লিখেই শেষ করেন নি। তিনি সমকামি মেয়েদের নিয়ে সেই দ্বীপে একটা উৎসব করেন। তখন থেকেই সমকামি মেয়েদের লেসবিয়ান বলে ডাকা শুরু হয়। তবে স্যাপোর সমকামি উৎসবের আগে লেসবো দ্বীপের বাসিন্দাদের লেসবিয়ান বলে ডাকা হতো।

সমকামি গোত্রের আরো দুই প্রবৃত্তির যৌনাচার আছে; উভকামিতা ও বিষমকামিতা। উভকামিরা বিপরীত লিঙ্গের প্রতি যেমন আকর্ষণ অনুভব করে তেমনি সমলিঙ্গের প্রতিও আকর্ষণ অনুভব করে। আর বিষমকামিদের বলা হচ্ছে, জেন্ডার ব্লাইন্ড। অর্থাৎ বিষমকামিরা, সব লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণবোধ করে। সে হোক নারী, হোক পুরুষ, হোক গে, অথবা হোক লেসবিয়ান। এদের যৌনাচারে লিঙ্গভেদ মুখ্য নয়।

গবেষকদের মতে, মানবজাতির শুরু থেকেই সমকামিতা ছিলো। এখনো সমকামিতা আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণকে প্রতিটি সমাজে স্বাভাবিকভাবে দেখা হলেও সমকামিদেরকে প্রায় প্রতিটি সমাজেই নিগৃহীত হতে হয়েছে। সময়ের সাথে সাথে উদার জাতি ও দেশগুলি সমকামিতাকে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক স্বীকৃতি দিচ্ছে। তাদের বিয়ে, সন্তান দত্তক নেওয়া, আইনগত সহায়তা ইত্যাদি বিষয়ে তারা যত্নবান হচ্ছে। সমকামিদের নিজস্ব পতাকাও আছে। কিন্তু, আমাদের সমাজে সমকামিরা এখনো নিগৃহীত। আমাদের সমাজ সমকামিদের অধিকারের দিকে নজর না দিলেও তাদের হেয় করার প্রবণতা এখনো বিদ্যমান। আমরা অনেকেই উদার চিন্তা লালন করলেও সমকামিদের মানসিকভাবে নির্যাতন করছি অহরহ। একজন সমকামি পুরুষ বা নারী অন্য একজন সমকামি পুরুষ বা নারীকে পেয়ে গেলে তাদের যৌন প্রয়োজন মেটানোর একটা স্থায়ী সমাধান হতে পারে। কিন্তু, একজন উভকামি পুরুষ বা নারীর ক্ষেত্রে এটা একটু জটিল।

মানসিক ও সামাজিক নির্যাতন
পৃথিবীর কোনো প্রয়োজনই থেমে থাকে না। প্রয়োজন মানুষকে দুর্নিবার করে তোলে। সমকামিরাও তাদের প্রয়োজনেই সমলিঙ্গের পুরুষ বা নারীর দিকে এগিয়ে যায়। কোনো সমকামি বা উভকামি যৌনতা অনুভব করে কোনো Heterosexual (বিপরীতলিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট) মানুষের দিকে এগিয়ে আসলে আর সেটা বুঝতে পারলে তাকে খুব তাচ্ছিল্য করা ও এড়িয়ে চলা হয়। এই তাচ্ছিল্য ও অপমান তাদের জীবনযাপনে প্রভাব ফেলে এবং তাদের কর্মতৎপরতা কমে যায়। পাশাপাশি মানসিক সমস্যাও দেখা দিতে পারে। প্রতিটি মানুষের যৌনতার ধরণ নির্ভর করে হরমোনের উপর। সমকামি ও উভকামিদের এই যৌন আচরণও তাদের শরীরে উপস্থিত হরমোন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সমকামি ও উভকামি জীবন প্রাপ্তির জন্যে সে দায়ী নয়। এটা যদি আমরা বুঝে থাকি, তাহলে তাদের তিরস্কার করে বা অপমানিত করে আমরা নিশ্চয় অন্যায় করি। একটা কাজ অন্তত আমরা সবাই করতে পারি- তাদের যৌন আবেদন গ্রহণ করতে না পারলেও অবজ্ঞা করা বা অপমানিত করা বন্ধ করতে পারি। আর এটাই হবে মানবিক কাজ। এতে তারা মানসিক সমস্যায় কম ভুগবে।

অনেক ক্ষেত্রে সমকামিরা Heterosexual (বিপরীতলিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট) পুরুষ বা নারীদের দ্বারা হয়রানির শিকার হয়। সামাজিক লজ্জার ভয়ে অধিকাংশ সমকামি বা উভকামি তা কাউকে বলতে পারে না। আবার অনেকেই কৌতূহলবশত সমকামি বা উভকামিদের কিছুটা সঙ্গ দেওয়ার পর এড়িয়ে চলে। তখন সে আবার অন্য কাউকে খুঁজে নেওয়ার অনিশ্চয়তায় ভোগে।

অধিকার ও প্রকাশ
যেহেতু আমাদের দেশে সমকামিতা লজ্জিত ও নিগৃহীত বলে ধরে নেওয়া হয়, তাই সমকামি বা উভকামিরা নিজেদের যৌনাচার গোপন করার মধ্যেই নিরাপত্তা অনুভব করে। ফলে তারা তাদের অধিকার আদায়ের কথা বলা দূরের কথা, কেউ জেনে যাবে এই ভয়ে তারা নিজেদের আরো লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করে। অন্যদের নির্যাতনের ভয়ে সমকামি ও উভকামিরা নিজেদের এই যৌনাচারকে নিজেরাও ধিক্কার দেয়। নিজেদের সমকামি ও উভকামি জীবনকে অভিশপ্ত বলে মনে করে। তারাও আমাদের সবার মতো বঞ্চনা ও নির্যাতনমুক্ত জীবন যাপন করতে চায়। আমরা সবার প্রয়োজনকে অধিকার বলে মনে করলে, তাদের এই প্রয়োজনকেও অধিকার হিশেবে মূল্যায়ন করা উচিত।

পুনশ্চ:
০১. বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষিত মানুষের যৌনাচারকে প্রয়োজনের দৃষ্টিতে দেখলে সমকামি ও উভকামিদের যৌনাচারকেও প্রয়োজনের দৃষ্টিতে দেখা উচিত নয় কী?
০২. প্রতিটি প্রয়োজনের পক্ষে আমার অবস্থান। সমকামি ও উভকামিদের এই প্রয়োজনের পক্ষে দাঁড়ানো আমার মানবিক দায় বলেই তাদের পক্ষে দাঁড়ালাম।
০৩. বিষমকামিরা উভকামিদের প্রায় কাছাকাছি বলে তাদের বিষয়ে আলাদা করে কিছু বলা হলো না।

No comments:

Post a Comment