রবীন্দ্রনাথের ফ্যাশন : পরিপাটি সাজগোজে তাঁর তুলনা হয় না |
রবীন্দ্রনাথের ফ্যাশন ভাবনা জানতে গেলে মুগ্ধ
হতে হয়। লেখক হিশেবে রবীন্দ্রনাথ যেমন রুচিশীল ও আধুনিক; তেমনি ফ্যাশনেও অসামান্য। নতুন নতুন ফ্যাশনেবল পোশাক তৈরি করে নিজে পরে হলেও তিনি ফ্যাশনেও খানিক অবদান রেখে
গেছেন বলে আমি মনে করি। রবীন্দ্রনাথ শুধু একা নন, ফ্যাশনের দিক থেকে পুরো ঠাকুরবাড়ি ছিল সমান্তরালভাবে অন্যন্য
আধুনিক, সচেতন ও রুচিশীল।
আমাদের আজকের সময়ে ফ্যাশনের ধরনধারণ,
উপস্থাপন ও নিয়ন্ত্রণ করে বিভিন্ন ফ্যাশন হাউজ, ফ্যাশন ডিজাইনারা অথবা গনমাধ্যম। সেসময় কোনো ফ্যাশন হাউজ ছিল না। ছিল ঠাকুরবাড়ি। ঠাকুরবাড়ি মানেই ফ্যাশনে ও পোশাকে নিত্যনতুন বাহারের সমারোহ। সেই ফ্যাশন প্রভাব বিস্তার করেছে সমস্ত বাঙালির মধ্যে। আমাদের এই সময়ে ঠাকুরবাড়ির ফ্যাশনগুলি ধরে রাখতে না পারলেও কিছু এখনো নিত্যদিনের
সঙ্গী। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবী ফ্যাশনের
দিক থেকে ঠাকুরবাড়ির নারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উদ্ভাবনী মনের ছিলেন। তিনি প্রথম চালু করেন শাড়ির সাথে ব্লাউজের ব্যবহার এবং কুঁচি করে শাড়ি পড়ার চল। অন্যসব বাদ দিলেও এই দুটি এখনো বাঙালি নারীর নিত্যদিনের সঙ্গী।
ফ্যাশনের দিক থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আজো
অনুকরণীয়। শুধু ফ্যাশন নয়, ব্যক্তির নিজস্ব
বৈশিষ্ট্য ও ব্যক্তিত্ব ফুটিয়ে তোলাকে তিনি প্রাধান্য দিয়েছেন। আর পরিপাটি সাজগোজে তাঁর তুলনা হয় না। ফ্যাশনেবল রবীন্দ্রনাথ
নিজস্ব স্টাইলকে প্রাধান্য দিয়েছেন অনেক। তিনি ফ্যাশন ও স্টাইল
নিয়ে বলেছেন, 'ফ্যাশানটা হল মুখোশ, স্টাইলটা হল মুখশ্রী'।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অভিজাত হিন্দু পরিবারের
সন্তান হিশেবে ধুতি, পাঙ্গাবি বা লুঙ্গি যেমন পরেছেন; তেমনি বিলেতে ব্যারিস্টারি পড়তে গিয়ে পরেছেন স্যুট-প্যান্ট। তবে সেখানেও পাওয়া গেছে তাঁর স্বতন্ত্র উপস্থাপনা। সবকিছুতেই তাঁকে মানিয়েছে। প্রতিদিনের পোশাকে
তিনি বাড়িতে পরতেন গেরুয়া বা সাদা রঙের জোব্বা আর পায়জামা। বাহিরের যাওয়ার সময় পরতেন জোব্বা ও সাদা ধুতি। সাথে জামাও পরেছেন। আর বরাবরের মতো তিনি ব্যবহার করতেন শাল।
রবীন্দ্রনাথের ছবি দেখলে তাঁর পোশাকে রঙের
ব্যবহার বোঝা যায় না। কিন্তু, তিনি রঙের ব্যবহার করেছেন মনের মাধুরী মিশিয়ে। ঋতু উৎসবে ঋতু অনুসারে তিনি ব্যবহার করতেন নানা রঙের রেশমী শাল। বর্ষায় ব্যবহার করতেন কালো বা লাল রঙের শাল, শরতে সোনালি কিংবা বসন্তে বাসন্তি রঙ। আবার কখনো কখনো জোব্বার
রঙের সাথে ম্যাচ করে বেছে নিতেন সেই রঙের শাল। তিনি মাঝে মধ্যে টুপিও পরেছেন।
ভিনদেশি ফ্যাশনের সাথে বাঙালিয়ানা ফ্যাশনের
মিশ্রণ সেসময় ঠাকুরবাড়িতে সবচেয়ে বেশি ঘটেছে। রবীন্দ্রনাথ জাপানিদের কিমানো ব্যবহার করেছেন নিজের মতো করে। কিমানোর সাথে তিব্বতিদের বাকুর মিশ্রণে জোব্বা তৈরি করে পরেছেন। পাহাড়ি কিংবা বাউলদের পোশাকের মিশ্রণও রবীন্দ্রনাথের পোশাকের মধ্যে পাওয়া যায়। তিনি ঐতিহ্য আর আধুনিকতার মিশ্রণে পোশাক তৈরি ও নির্বাচনে নিপুণ ছিলেন। পোশাকে তিনি স্টাইলিশ ছিলেন বলে, জোব্বার হাতা,
কলারের ধরণ, জোব্বার বা কোটের বোতাম,
জোব্বার দৈর্ঘ্য ইত্যাদিতে নতুনত্ব আনতেন।
রবীন্দ্রনাথ শুধুমাত্র একটি পোশাকে কখনো নিজেকে
আবদ্ধ রাখেন নি। রুচির মধ্যে ভিন্নতা আনার প্রবণতা ছিল সবসময়। এতেই বোঝা যায় তিনি ফ্যাশনেবল ও স্টাইলিশ মানুষ ছিলেন। তিনি যা পরতেন সেটাই তাঁর ব্যাক্তিত্বের সাথে চমৎকারভাবে মানিয়ে যেতো। তাঁর ব্যক্তিত্ব ফুটে উঠে নি এমন কোনো পোশাক তাঁকে পরতে দেখা যায় নি। এখানেই রবীন্দ্রনাথের ফ্যাশনের সবচেয়ে বড়ো সার্থকতা। স্টাইলটাই যে আসল, তিনি তাঁর ফ্যাশনের
মধ্য দিয়ে চমৎকারভাবে দেখিয়েছেন।
No comments:
Post a Comment