Friday, October 4, 2013

ছোটগল্প :: রাস্তা

রুমন আনাম এর ছোটগল্প

রাস্তা



স্বভাবের দিক থেকে আবুল মিয়া খুব সাধসিধে। বুদ্ধিতেও খুব ঢিলা প্রকৃতির। কাজকর্মে ছন্দ নাই। এই অল্প বুদ্ধির মানুষটাকে সবাই পাগল বলে। রাস্তায় চলার সময় দুষ্টু বুদ্ধির লোকেরা তাকে খোঁচা দেয়। সে ক্ষেপে যায়। তার ক্ষেপে যাওয়া দেখে ওরা আনন্দ পায়। খানিক বাদে শান্ত হয়ে আবারো পথ চলতে থাকে। বিয়ের পর আবুল মিয়ার চলাফেরাতে গা বাঁচিয়ে চলা লক্ষ করা গেলো। যে মেয়েটিকে সে বিয়ে করলো, সে অতিশয় বুদ্ধিমতি মেয়ে না হলেও আবুল মিয়ার অল্পবুদ্ধি দেখে সে যেন চতুর এক নারীর রূপ নিল। আবুল মিয়া ভুল করতে পারে বলে তার চলাফেরা আবুল মিয়ার বউ নিয়ন্ত্রণ করতে লাগলো। এরপর থেকে আবুল মিয়ার ভুল অনেক কমে গেলো। সে গোছালো মানুষ হয়ে না উঠলেও তার মধ্যে একটা সাবধানী ভাব দেখা গেলো। আবুল মিয়ার বউয়ের এই অবস্থান দেখে অনেকেই তাকে চালু মেয়ে বলে আখ্যা দিলো। তারা এটাকে ভালোভাবে নিলো না। কেউ কেউ আবুল মিয়ার বউকে সাধুবাদ জানালো। তারা মনে করলো, "আবুল মিয়া পাগল মানুষ, বউ এমন না হলে সংসার টিকবে না।"


আবুল মিয়ার তেমন জমাজমি ছিল না। ঘরবসতির পাশাপাশি কয়েক কাঠা আবাদি জমি ছিল। আবুল মিয়ার অন্য ভাইদের কেউ দিনমজুরের কাজ করতো আবার কেউ হাটে হাটে তরিতরকারির ব্যবসা করতো। আর আবুল মিয়া হাটে হাটে গুঁড়া হলুদ বিক্রি করতো। এভাবেই চলতো তার সংসার। আবুল মিয়ার দুটি সন্তান হল। একটি মেয়ে ও একটি ছেলে। মেয়েটি বড়ো। আবুল মিয়ার মতো তার মেয়েটিও হলো অল্প বুদ্ধির। তবে ছেলেটা হলো কিছুটা মায়ের মতো। অভাবের সংসারে আবুল মিয়া মেয়েটিকে খুব বেশি পড়াশোনা করাতে পারলো না। মেয়েটি যৌবনের দুয়ারে পা না দিতেই তার বিয়ে দিয়ে দিলো। সংসারে টানাটানি থাকলেও আবুল মিয়ার বউয়ের চোখে ছিলো স্বপ্ন। তাদের মেয়েটি অল্প বুদ্ধির হলেও কিছুটা রূপ ছিল। আবুল মিয়ার বউ স্বপ্ন দেখেছিলো তার মেয়েকে সুন্দর একটা ছেলেকে দিয়ে বিয়ে দেওয়ার। অনেক দেখে শুনে সে সেটাই করলো।

বিয়ের খরচ একেবারে কম নয়। তবু চেষ্টা করলো ভালো করে মেয়ের বিয়েটা পার করতে। তারা মেয়ের জামাইকে দিলো ভালো ভালো উপহার ও ভালো যৌতুক। আবুল মিয়ার বউ সাবধানী মানুষ। তাই একটু একটু করে টাকা জমিয়ে তার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিল। কিন্তু, তাতেও কুলিয়ে উঠতে পারলো না। শেষে তারা ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে মেয়ের বিয়ে দিলো।

আবুল মিয়ার সুদর্শন মেয়ের জামাই দেখে সবাই প্রশংসা করতো। আবুল মিয়ার তেমন কোনো অনুভূতি বোঝা না গেলেও তাদের মেয়ের জামাইয়ের প্রশংসা শুনলে তার বউয়ের চোখে-মুখে খুশির আভা দেখা যেতো। বছর দুই পর আবুল মিয়ার মেয়ে একটি ছেলে সন্তানের মা হলো। অল্প বুদ্ধির এই মেয়ে নিজের শাড়ির আঁচল ঠিকমতো সামলাতে না জানলেও সময়ের সাথে সাথে তাকে মা হতে হলো। মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার পর আবুল মিয়ার খরচ কমে নি। বরং আরো বেড়ে গেলো। সময়ে অসময়ে মেয়ে-জামাইয়ের জন্যে অনেক কিছু করতে হতো।

নাতি হবার পর আবুল মিয়ার খরচ আরো এক দফা বেড়ে গেলো। এদিকে আবুল মিয়ার ঋণ শোধ হয় না। দিন দিন তার ঋণের বোঝা বাড়তেই থাকলো। এক এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে আরেক এনজিও তে কিস্তি দিয়ে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকলো। আস্তে আস্তে আবুল মিয়ার সংসার দুঃখের সাগরে পরিণত হলো। এরই মধ্যে আবুল মিয়ার মেয়ের ওই সংসারে জায়গা হলো না। সংসার ভাঙার পর মেয়ে ও নাতির আশ্রয় হলো তার কাছেই।

সমাজে আবুল মিয়ার মান বলে আর কিছু থাকলো না। ঋণের চাপে সে দিগ্বিদিক হয়ে পড়লো। বসতবাড়ি ছাড়া যেটুকু আবাদি জমি ছিল, তাও বেচে দিলো। তবু ঋণ থেকে মুক্ত হতে পারলো না। এনজ এর লোকেরা প্রায় এসে মান অপমান করতে লাগলো। অবশেষে একরাতে আবুল মিয়া সবাইকে নিয়ে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গেলো অনেক দূরের শহরে। সেখানেও আবুল মিয়ার মতো অল্প বুদ্ধির মানুষকে কেউ কাজ দিতে চায় না। কাজ দিলেও বেশিদিন সেই কাজ টিকে না। সংসারের খরচ একেবারে কম নয়। মেয়ের সংসার ভাঙার পর ছেলেটাকে নিয়ে আবুল মিয়া ও তার বউয়ের স্বপ্ন আরো বেড়ে গিয়েছিলো। কিন্তু, শহুরে জীবনে সংসারের খরচ অনেক বেশি। তাই বাধ্য হয়ে ছেলেটার স্বপ্নকে জলাঞ্জলি দিয়ে তাকে দোকানের কাজে লাগিয়ে দিলো। তারপরেও  সংসারের খরচ সামাল দিতে খুব কষ্ট হচ্ছিলো। খেয়ে না খেয়ে চলতে থাকলো বেঁচে থাকার সংগ্রাম।

সংসারের করুণ অবস্থা আর পালিয়ে বেড়ানোর যন্ত্রণা আবুল মিয়া আর তার বউকে পাগল করে দিলো। তবু জীবন বাঁচানোর জন্যে আবুল মিয়া টলতে টলতে চলতে থাকলো। এভাবেই তারা পার করলো দুই বছর। একদিন আবুল মিয়া কাজ থেকে ফিরছিলো। আনমনে রাস্তা পার হতে গিয়ে একটা চলন্ত বাস সজোরে ধাক্কা দিয়ে আবুল মিয়াকে রাস্তা থেকে ফেলে দিলো। ছিটকে গিয়ে লুটিয়ে পড়লো মাটিতে। আর দাঁড়াতে পারলো না। আবুল মিয়া "ও মা, ও বাবা" বলে গোঙাতে থাকলো। গলগল করে বেরিয়ে যাচ্ছিল রক্ত। পথচারীরা তাকে বাঁচানোর জন্যে ধরাধরি করে রাস্তায় উঠাতে গেলো। আবুল মিয়া সেই সময় দিলো না। আর রাস্তায় উঠলো না। আবুল মিয়ার গোঙানি থেমে গেলো। আবুল মিয়ার প্রাণ পাখি আবুল মিয়াকে ছেড়ে চলে গেলো। ওরা রাস্তায় তুলে আনলো নিথর দেহ।

No comments:

Post a Comment