Monday, February 18, 2013

মিলমিশের আগে চাই সততা


মিলমিশের আগে চাই সততা


লেখার প্রথমেই হুমায়ূন আহমেদ এর মতের বিরোধিতা করছি। তিনি ২৬জুলাই এর একটি জাতীয় দৈনিকে এক লেখায় পারিবারিক ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। যেখানে মাজারে গিয়ে ঔ দলের শিশু রিসাদ আল্লাহপাকের কাছে একটি নীল রংয়ের গাড়ি চায় এবং সে পেয়েও যায়। তাকে বলা হয়েছে যে, সে যা চাইবে তাই পাবে। সেদিন হুমায়ূন আহমেদ নিজে অন্য কিছু চেয়েছেন। তিনি যা চেয়েছেন তার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে, ‘‘হে আল্লাহপাক তুমি আমাদের দেশের দুই নেত্রীর মধ্যে মিলমিশ করে দাও। দেশের মানুষ এটা চাচ্ছে, কিন্তু হচ্ছে না। তুমি চাইলেই হবে।’’ এবং সেই লেখায় তিনি দেশের সবাইকে নিয়ে একটা প্রার্থনা দিবসেরও আয়োজন করতে চাওয়ার কথা বলেছেন।


তাঁর ইচ্ছা এরকম যে, দেশের মানুষ সবাই মিলে প্রার্থনা করবেন এবং আল্লাহ প্রার্থনা চাইলে মঞ্জুর করবেন। তিনি আরো বলেছেন যে, সবাই এটা চাচ্ছে। আমার বিরোধিতাটা এখানেই। কেননা তিনি অসম্ভব কিছু চেয়ে বসেছেন। যদি বলেন অসম্ভব বলে কিছু নেই। আর যদি তা সম্ভবও হয় তবে তা কখনোই টেকসই কিছুতে পরিণত হবে না-তা আগে থেকেই বলে দিতে পারি। এরপর ইমদাদুল হক মিলনও তাকে সমর্থন জানিয়ে মতামত ব্যক্ত করেন। পরে অনেকেই এটা নিয়ে একমত প্রকাশ করে বিজ্ঞের আসনে আসীন হতে চেয়েছেন। আমার বক্তব্য এর বিপরীত।

একটা পরিবারের গল্প বলি। পরিবারটি একান্নবর্তী পরিবার। পরিবারে আছেন মা, বড়োছেলে, ছোটোছেলে, দুই ছেলের দুই বউ ও তাদের একটি করে মেয়ে। পরিবারটি একটি সম্ভ্রান্ত পরিবার। ফলে সবাই তাদের মেনে চলে। তারাও তাদের মর্যাদা বজায় রাখতে সচেষ্ট। সবাই জানে তাদের মধ্যে খুব ভালো সম্পর্ক-এটাই তাদের ধারণা। তাদের চলাফেরা বা আচারআচরণে কেউ ধরতেও পারে না যে তাদের মধ্যে কোনো সখ্যতা নেই। তাই তাদের বেশ ফুর্তি। তারা আরো মনে করে যে, যদিও কেউ জানে তবে তা তাদের নিকটজন। তাই সমস্যা নেই।

অনুসন্ধানে জানা গেল ঘটনাটা অন্য। তাদের মধ্যে কোনো ভালো সম্পর্ক নেই। বিশেষ করে বউদের মধ্যে। আর এও জানা গেল যে, কমবেশি সবাই এই তাদের সম্পর্ক অবনতির কথা জানে। কিন্তু সম্ভ্রান্ত পরিবার বলে কেউ প্রকাশও করে না। আবার দিনে দিনে জানাজানির কেউ বাদও পড়ছে না। কিন্তু তারা তাদের নিজেদের সম্পর্ক অবনতির কথা কখনোই বাইরে প্রকাশ করে না। তারা চান ভালোটি বুঝাতে কিন্তু পাবলিক সবই জানে।

হুমায়ূন আহমেদ যদি সবাইকে নিয়ে প্রার্থনা করেন আর যদি আল্লাহ মঞ্জুর করেন তবে আমাদের দুই নেত্রী একত্র হতে পারেন। তারা এক জায়গায় যেতে পারেন। একই মঞ্চে বক্তব্য দিতে পারেন। একে অন্যকে দোষারোপ না করে ভালোবাসাবাসিও করতে পারেন। কিন্তু যদি তা লোক দেখানো হয় তবে কি কোনো কাজ হবে? আর যদি তারা মনে করেন যে, লোকে তাদের ভালো সম্পর্কের কথা জানেন, তাদের বন্ধুত্বের কথা জানেন, তাদের মতের মিলের কথা জানেন। আর অন্যদিকে লোকে যদি তার উল্টো জানে তবে কি এই পরিবারের মতোই আমাদের দেশের দুই নেত্রীর বেলায় হবে না?

যদি তাও না হয়ে থাকে অর্থাৎ আমাদের দুই নেত্রীর মিলমিশ হয় তবে কি হবে? আমাদের দেশ আরো উন্নতি লাভ করবে? আমি বলবো কখনোই করবে না। কেননা গণতন্ত্র মানেই কিন্তু একজন আরেকজনের বিরোধিতা করবে এটাই স্বাভাবিক। রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়ুয়ারা আমার চেয়ে আরো ভালো বলতে পারবেন। মি. হুমায়ুন আহমেদ, ধরে নিন যে আপনার প্রার্থনা অনুযায়ী দুই নেত্রী মিলমিশ হয়ে গেছে এবং তারা একত্রে কাজ করছে। যদি এক নেত্রী একটি মতামত খাড়া করেন আর যদি অপর নেত্রী তার সমর্থন করেন তবে তা থেকে ভালো কিছু বেড়িয়ে আসতে পারে কি? কখনোই না। কেননা সৃষ্টি হতে গিয়ে কোনোকিছু যদি দ্বান্দ্বিকতার মধ্যে না পড়ে তবে তা থেকে আরো ভালো কিছু পাওয়া যেতে পারে না। যে বা যিনি একটি পরিকল্পনা খাড়া করবেন তার চেয়ে আরো ভালো ও উন্নত পরিকল্পনা বা মতামত আরেকজনের কাছে থাকতে পারে-তা স্বীকার করতে হবে। আর যদি অন্যজন কোনো মতামত খাড়া করতে না পারেন তবে বোঝা যাবে দুটো জিনিশ।

এক. হয়তো তিনি ভালো দেখে এটি সমর্থন করছেন।
দুই. নয়তো তার কোনো নিজস্ব মতামত নেই।

অর্থাৎ এখানে আরো স্পষ্ট করে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, যিনি সব মেনে নেবেন তিনি হয় পুতুল চরিত্রের একজন, ভীতু, যন্ত্র (যদিও এখনো এমন কোনো যুগ আসেনি বা দেশের কথা শোনা যায়নি যেখানে যন্ত্র আর মানুষ মিলে রাষ্ট্র চালাচ্ছে। আর যদিও যন্ত্র তৈরি হয় তবে তা মতামত দেবে, এমন করেই তৈরি করা হবে।) নয়তোবা মতামতহীন। এর যদি কোনোটাও এ ক্ষেত্রে হয়ে থাকে তবে তিনি জনগণের কল্যাণে কিছুই করতে পারবেন না।

মোটকথা আমি বলতে চাই গণতান্ত্রিক দেশে মতের পার্থক্য থাকবেই। মতের প্রার্থক্যের জন্যই তো গণতন্ত্র। আমি যে মিলমিশের বিপক্ষেই কথা বলতে চাইছি তা নয়। আমি নিষ্ঠাহীনতার বিরুদ্ধেও কথা বলতে চাইছি। যদি তারা নিষ্ঠাবান হন তবে মিলমিশ এমনিতেই এসে যাবে। আমাকে বা আপনাকে ডেকে এনে মিলমিশকে তাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে হবে না। তারা একাই সেই মহামিলনে মিলিত হবেন।

যদি আমাদের দেশে কেউ রাজনীতির প্রতি তথা দেশবাসির প্রতি যত্নশীল হয়ে ক্ষমতার মোহ থেকে দূরে গিয়ে শুধু দেশের সেবা ও উন্নতির জন্য ভাবেন ও তদানুযায়ী কাজ করেন তবে তাকে ক্ষমতা হারানোর ভয়ে ভীত হয়ে থাকতে হবে না। আগেই আমাদের ক্ষমতা নামক সোনার হরিণটাকে মন থেকে দূরে রেখে মন শঁপে দিতে হবে দেশের জন্য ও দেশের মানুষের জন্য। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি সে দল বা সেই নেতার আর পেছনে তাকাতে হবে না। তবে মেকিভাবে মন থেকে ক্ষমতার মোহ দূর করলে হবে না! সারকথা এই যে, ক্ষমতার মোহ ছাড়ুন, ক্ষমতা আপনাকেই জড়িয়ে ধরবে। এতে করে আপনার মানবজীবন স্বার্থক হবে। অমরত্ব অবশ্যই আপনার জন্য অপেক্ষা করবে। কেননা, তখন আপনি একজনের বরাদ্দকৃত কাজ আপনার সময়ে আটকাবেন না, অন্যের নিন্দা করার জন্য সময় ব্যয় করবেন না, দলীয় সন্ত্রাস দমনে সচেষ্ট হবেন, আপনার ভেতরে কাজ করবে এক শোষণহীন সমাজের স্বপ্ন, আপনি মৌলবাদিদের আশ্রয় দেবেন না, আপনার স্বজনকে আপনি অনৈতিক সুবিধা দিবেন না। আর ফলশ্রুতিতে সুধীসমাজ আপনাদের আর ঘৃণাও করবে না।

চলতি বছরসহ আমাদের মতো দেশ থেকে পরপর ৯জন ব্যক্তি এশিয়ার নোবেল খ্যাত র‌্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কার পেলেন। এই পুরস্কার রাজনীতিভিত্তিক কাজের উপরও দেওয়া হয়। কিন্তু আমাদের দেশের কোনো রাজনীতিক কেন ম্যাগসেসে পুরস্কার পেলেন না? আমাদের একই ভূখন্ডে বসবাস করে যদি একজন মানুষ মূলত: মানুষের নেতা না হয়েও মানুষের সেবার জন্য ম্যাগেসেসে পুরস্কার পান আর রাজনীতিকরা যাদের কাজটায় হলো কিনা দেশ তথা মানুষের সেবা করা, তারা কেন ম্যাগসেসে পুরস্কার পান না? এই প্রশ্ন তাদের করতে হবে। তাদের এই পুরস্কার নিতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। আমাদের দুই নেত্রীর মিলমিশ আশা করাটা একেবারেই কাজের কাজ হবে না। কেননা যুক্তরাজ্যের নেতাদের মতো এই দেশের নেতারা বিজয়ী প্রতিপক্ষকে অভিনন্দন জানাতে পারবেন না। আর তাই সহযোগিতা বা মিলমিশ আশা করা অসম্ভব এক বস্তু।

রুমন আনাম

এই লেখাটি বেশ পুরনো। এটা সম্ভবত ২০০৬ অথবা ২০০৭এর দিকে লেখা।

No comments:

Post a Comment