Wednesday, February 13, 2013

বাংলাদেশে শিশুশিক্ষার বাণিজ্যে প্রকৃত শিক্ষা-সংকট

বাংলাদেশের কিন্ডারগার্টেনের শিশুরা বইয়ের বোঝা বয়ে চলে

শিক্ষা নিয়ে আমাদের দেশে ব্যবসা হয় তা আমরা সবাই প্রায় জানি। কিন্তু শিশু শিক্ষার মতো স্পর্শকাতর বিষয়েও যে নির্মম ব্যবসা ও শিক্ষার নামে নির্যাতন হয়, তা আমরা অনেকেই বুঝতে পারি না। অথবা বুঝলেও কিছু করতে পারছি না।

এখন শিক্ষার সাথে যুক্ত হয়েছে বাবা মায়ের মর্যাদাবোধ ও সামাজিক জৌলুশ প্রকাশের হীন চেষ্টা। এই জাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে আমাদের কোমলমতি শিশুরা। মাঝখানে শিক্ষা ব্যবসায়ীরা লুটে নিচ্ছে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা।

২০-২৫ বছর আগেও আমরা দেখেছি, ৫ থেকে ৬ বছর বয়সে একটি শিশুকে স্কুলে দেওয়া হতো। প্রথম স্কুলে গিয়ে সে ভর্তি হয় শিশু শ্রেণিতে। এই শিশু শ্রেণিকে কোথাও ছোট ওয়ান নামের বলা হয়। তখনো কিন্ডারগার্টেন নামক অদ্ভুত শিক্ষাব্যবস্থার প্রকোপ এতোটা বিস্তার করেনি। কিন্তু এখন এই অদ্ভুত শিক্ষাব্যবস্থা বিষফোঁড়ার মতো যন্ত্রণাদায়ক হলেও আমরা যে, কিভাবে তা সহ্য করছি তা, ভাবা যায় না। বোধহয়, বঙ্গদেশেই এমন অদ্ভুত বস্তু দিনের পর দিন ফুলে ফেঁপে বাড়তে পারে।


তো, তখনকার সময়ে বা এখনো প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলিতে একটি শিশু প্রথম ভর্তি হয়ে স্কুলের পরিবেশে নিজেকে ধীরে ধীরে খাপ খাইয়ে নেয় আর খেলার ছলে কিছু শিখতে থাকে। পরিবারের পরিবেশ থেকে শিশুকে স্কুলের পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে এবং তাকে পড়াশোনার প্রতি আগ্রহী করতেই শিশু শ্রেণির ব্যবস্থা। এটাকে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাও বলা হয়।

কিন্তু এখন? এখন শিশুশিক্ষা নিয়ে এক বিশাল ক্যনাভাসের অরাজকতা চলছে। একটি শিশুর বয়স সাড়ে তিন বা চার হলেই স্কুলে নিয়ে নিচ্ছে। তাকে ভর্তি করিয়ে নেওয়া হচ্ছে নার্সারি শ্রেণিতে। এর পরের বছর সে ওঠে কেজি ওয়ানে এবং তার পরের বছরে ওঠে কেজি টু তে। ক্লাশ ওয়ানে বা প্রথম শ্রেণিতে উঠতে একটি শিশুকে তিন বছরের ঘানি টানতে হয়। আর এর মধ্যে বাবা মায়ের অবস্থাও কাহিল হয়ে পরে।

আরো অদ্ভুত ব্যাপার হলো যে, এই স্কুলগুলি একটি আরেকটির মতো না; অথবা আমরা বলতে পারি সব স্কুলের শিক্ষাপদ্ধতি এক না। এক স্কুলে একরকম বই দিলে আরেক স্কুলে আরেক রকম বই। এক স্কুলে ক্লাশ ওয়ানে ৮টা বই দিলে আরেক স্কুলে দেওয়া হয় ১২টা বই। এভাবে, যে যার মতো বই চাপিয়ে দিয়ে ঘুম হারাম করে নিরস শিক্ষা-যুদ্ধে নামিয়ে দিচ্ছে কোমলমতি শিশুদের।

আমার এক নিকটজনের বাচ্চা ক্লাশ টু তে পড়ে। আজ জানতে পারলাম, তার স্কুলের বই মোট ১৩টি। সিটি কর্পোরেশন-এর অধীনে একটা নামকরা স্কুলে সে পড়ে। নিয়মানুসারে তাকে সরকারি পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের বই দেওয়া হয়েছে তিনটা, আর স্কুলের উনারা চাপিয়ে দিয়েছেন অতিরিক্ত আরো ১০টা বই। এই শিশুটিকে মোট ২০টি খাতা মেইনটেইন করতে হয়। তার অংকের বই মোট ৩টি। ইংরেজির বহরও কম না। ফলে এই শিশুকে এতোগুলি বই গেলাতে গিয়ে বাবা মা জল্লাদের মতো আচরণ করে। এক টিউটর গেলেই আসে আরেক টিউটর। এই নিয়ে সারাদিনে শিশুটির বিশ্রাম বা বিনোদনের কোনো নিজস্ব সময় থাকে না বললেই চলে। এরপরে আছে গানের ক্লাশ, ড্রয়িং ক্লাশ কিংবা কোচিংয়ের ক্লাশ। জানতে পারলাম, ওই শিশুর কম্পিউটার শেখানোর জন্যে যে বই আছে, তাতে শেখানো হচ্ছে ইনপুট ও আউটপুট ডিভাইসের নাম এবং এগুলোর আলাদা আলাদা কাজ। আরো আছে বিট, বাইট, কিলোবাইট, মেগাবাইট, গিগাবাইট, টেরাবাইট ইত্যাদি জানার লেসন। অসময়ে অপ্রয়োজনীয় এই শিক্ষা গেলাতে একেকটা টিউটরকে রাখতে শিশুর বাবা মা কে ২০০০ টাকা থেকে ৪০০০টাকা দিতে হয়।

এখন বাবা মায়েরা এরকম জল্লাদখানায় তাঁদের শিশুকে দিয়ে খুব গর্ববোধ করেন। তাদের বাচ্চারা কম্পিউটারের মেগাবাইট-টেরাবাইট জানে বলে ভাবীদের গল্পে বাচ্চাকে নিয়ে গর্ব করাও যায়। কোনো মহিলার বাচ্চাকে অজ্ঞ বলে প্রমাণ করে নিজের এতোটুক বাচ্চাকে বিশাল মেধাবী বলে প্রকাশ করতে পারলে মায়েরা গর্বের ঠেলায় বাকবাকুম করতে থাকে। এই গর্ব আরো বেশি অনুভব করার উন্মাদ নেশায় বাবা মায়েরা কোমলমতি শিশুর ঘাড়ে চাপিয়ে দেয় তার থেকেও বেশি ওজনের বই-খাতা। যে স্কুলে বেশি বই-খাতা দেয় সেই স্কুল ভালো, এরকম একটি বেকুব ধারণা নিয়ে এখনো বাবা-মায়েরা ওইসব জল্লাদ স্কুলে দিয়ে বাচ্চাদের নির্যাতন করছেন।

এই সুযোগে, কিন্ডারগার্টেন নামক এই অদ্ভুদ শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যবসায়ীরা পকেট ভর্তি করে নিচ্ছে। এখন নামকরা একটা জল্লাদখানায় (কিন্ডারগার্টেনে) একটা বাচ্চাকে ভর্তি করাতে এক ধাক্কায় পকেট থেকে কম হলেও ১,০০,০০০ থেকে ১,৫০,০০০ টাকা ঢালতে হবে। এই টিনি-টিনি বাচ্চাদের স্কুলের বার্ষিক ফি কম করে ধরলেও ৫০,০০০টাকা শুরু।

এই অদ্ভুত চিত্র আমলে নিয়ে পরিবর্তন করা অত্যন্ত জরুরী। অন্তত, বাবা মায়েদের অর্থের অপচয়রোধের থেকে শিক্ষার নামে শিশু নির্যাতন থামানো অধিক জরুরী।

No comments:

Post a Comment